কথায় কথায় প্রতিশ্রুতি দেয়; কিন্তু সেই সংস্কারকে আইনগত ভিত্তি দিতে চায় না। ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের


সংস্কার নিয়ে কিছু রাজনৈতিক দলের অবস্থানকে দ্বিমুখী ও আত্মঘাতী উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, তারা মুখে সংস্কার মানে, কথায় কথায় প্রতিশ্রুতি দেয়; কিন্তু সেই সংস্কারকে আইনগত ভিত্তি দিতে চায় না। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বৈধতা না থাকে, তাহলে তা কীভাবে কার্যকর হবে?
সোমবার (৪ আগস্ট) রাজধানীর শাহবাগে ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম আয়োজিত চিকিৎসক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
ডা. তাহের বলেন, কিছু দল বলছে, ‘আমরা সব সংস্কার মানী, সাইন করে দিতেও সমস্যা নেই’। মনে হয় তারা খুব সংস্কারপন্থি, খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু এরপরই বলছে, এটাকে আইনগত ভিত্তি দিতে হবে না। তাহলে তো তাদের বক্তব্য দাঁড়ায়—‘আমি সালিশ মানী, কিন্তু তালগাছ আমার’। একদিকে ওয়াদা করবে, আবার বলবে—‘ওয়াদা ভঙ্গ করব না।’ অথচ কার্যকর করার জন্য যে আইনগত কাঠামো দরকার, সেটি মানতে রাজি নয়।
সংস্কারের আইনি ভিত্তি না থাকলে বাস্তবায়ন অসম্ভব, এমনটা জানিয়ে জামায়াত নায়েবে আমির বলেন, আমরা রক্ত দিয়েছি, জীবন দিয়েছি। তাই শুধু স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয়। পঙ্গুদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে, বঞ্চিতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এবং সবচেয়ে জরুরি হলো—এত বড় আন্দোলনের চূড়ান্ত অর্জন যেন বাস্তবে বাস্তবায়িত হয়।
তিনি আরও বলেন, একটা দল বলছে, আমরা সব সংস্কার মানী। কিন্তু তারা চার্টারে সই করতে চায় না, আইনি কাঠামো চায় না। তারা কেবল প্রতিশ্রুতির ভরসায় জনগণকে বোঝাতে চায়—যে আমরা ‘ওয়াদা করছি, ভঙ্গ করব না।’ এটা জনগণ মেনে নেবে—এমন চিন্তা করে থাকলে সেটা ভয়ংকর আত্মপ্রবঞ্চনা।
সংস্কারের আইনগত ভিত্তি ও জাতীয় ঐক্যের জন্য সব পক্ষকে দায় নিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, গত ১৫–১৬ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংগ্রাম করেছে, ত্যাগও দিয়েছে। কিন্তু তারা সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলতে পেরেছে, ফাইনাল খেলেছে জনগণ। নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররা। এটাই আন্দোলনের প্রকৃত রূপ—সামষ্টিক অংশগ্রহণ।
ডা. তাহের বলেন, পৃথিবীতে অনেক আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু এই আন্দোলনের আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—এখানে সবাই অংশ নিয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স তো ছিলই, এমনকি হাসপাতালের রোগীরাও আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। শিশুরাও রাস্তায় নেমেছে। একদিন দেখেছি, একজন মা কোলে শিশু নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এই বিপ্লবে তাই সবার অংশগ্রহণ রয়েছে। এরকম সর্বজনীন অংশগ্রহণ এই দেশের ইতিহাসে বিরল।
তিনি জানান, ২২ জুলাই তিনি গ্রেপ্তার হন এবং আগস্টের প্রথম সপ্তাহে কারামুক্ত হন। মুক্তির পর আহতদের দেখতে গিয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে দেখেছেন, অর্ধেকের বেশি আহত মানুষ রিক্সাওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা, ফেরিওয়ালা। আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের অবদানকে সামনে আনা হচ্ছে না। ডাক্তারদের অবদানও গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ ইতিহাসে সবার অবদান স্বীকৃতি পেতে হবে বলেও জানান তিনি।
৫ আগস্টের পর কিছু মানুষের লোভ বেড়েছে উল্লেখ করে এই জামায়াত নেতা জানান, ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর জনগণ আশাবাদী ছিল—দেশে আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতির অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ডা. তাহের। তিনি বলেন, এই বিপ্লবের পরে দেশের রাজনীতিতে আত্মকেন্দ্রিক ও লোভী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। জাতীয় ঐক্যের জায়গায় দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে।
তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর তো চাঁদাবাজি কমার কথা ছিল, দখলবাজি কমার কথা ছিল, কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। শুধু ব্যক্তি বদলেছে, দলের নাম বদলেছে, কিন্তু জনগণের জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আসেনি।
দেশে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেই অনেকে দাবি করছেন উল্লেখ করে ডা. তাহের বলেন, অবশ্যই ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যারা হারিয়েছে, তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা আছে, আশ্রয়দাতা আছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীর চেয়েও ভয়ানক হলো—যারা বিশ্বাসঘাতক। জনগণ বিশ্বাস করে কাউকে সামনে আনে, দায়িত্ব দেয়। কিন্তু সেই বিশ্বাসভঙ্গকারীই বেশি ক্ষতি করে।
তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর যারা সুবিধা নিয়েছে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে নিজেকে নিয়োজিত করেছে, তাদের ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাদের চিহ্নিত করে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করতে হবে।