গার্ডিয়ানের অনুসন্ধান

ইউরোপীয় অস্ত্র সহায়তায় গাজায় শিশু হত্যা

গাজার ওপর ইসরাইলের বিমান হামলায় ব্যবহৃত এক মারাত্মক বোমা জিবিইউ-৩৯ এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরবরাহ করছে ইউরোপের বৃহত্তম ক্ষেপণাস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এমবিডিএ। বৃটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান, ফরাসি সংস্থা ডিসক্লোজ এবং ডাচ প্ল্যাটফর্ম ফলো দ্য মানি যৌথভাবে এই তথ্য-উদ্ধার তদন্তে দেখিয়েছে, কীভাবে এই বোমাটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। আর প্রতিবারেই শিশু সহ অসংখ্য বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এ নিয়ে অনলাইন গার্ডিয়ানে বিস্তৃত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এমবিডিএ’র একটি কারখানা আছে যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা রাজ্যে। সেখানে বোয়িংয়ের তৈরি জিবিইউ-৩৯ বোমার জন্য ‘উইংস; বা ডানা প্রস্তুত করা হয়। এই ডানাগুলো বোমা ছোঁড়ার পর খুলে গিয়ে বোমাকে লক্ষ্যভেদে সুনির্দিষ্টভাবে পরিচালিত করতে সাহায্য করে। এই কারখানার লাভ এমবিডিএ ইউকে’র মাধ্যমে ফ্রান্সে অবস্থিত মূল এমবিডিএ গ্রুপে স্থানান্তর হয়। ২০২৩ সালে এমবিডিএ প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড লভ্যাংশ দিয়েছে এর তিন মালিক— বিএই সিজস্টেমস (ইউকে), এয়ারবাস (ফ্রান্স ও লিওনার্দো’কে (ইতালি)। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে জিবিইউ-৩৯ বোমা ইসরাইলে পাঠানো হয়েছে প্রায় ৪৮০০টি। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে পাঠানো হয়েছে সর্বশেষ ২১৬৬টি বোমা। দ্য গার্ডিয়ানের তদন্তে দেখা গেছে, অন্তত ২৪টি হামলায় জিবিইউ-৩৯ বোমা ব্যবহার করা হয়েছে। এতে শিশু সহ বহু বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। বেশির ভাগ হামলা হয়েছে রাতে কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই। যেমন—বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া পরিবার কিংবা তাঁবুর শিবিরে এই হামলা চালানো হয়েছে। 

২৬ মে রাত ২টার দিকে গাজা সিটির ফাহমি আল-জারজাবি স্কুলে বোমা হামলায় ৩৬ জন নিহত জন। এর অর্ধেকই শিশু। সেখানে আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলো ঘুমিয়ে ছিল হামলার সময়। সেই আগুনের মধ্যে একটি ছোট্ট মেয়ে— হানিন আল-ওয়াদি— জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। বেঁচে গেলেও তার মুখ ও হাত পুড়ে যায় এবং সে গভীর মানসিক আঘাত পায়। তার মা, বাবা ও একমাত্র বোন নিহত হয়। তার চাচা আহমেদ বলেন, ও বলে হাঁটতে ভয় লাগে— ভয় হয় মৃতদেহের ওপর না পা পড়ে। 

জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই হামলাগুলোকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ডোনোটেলা রোভেরা বলেন, জিবিইউ-৩৯ বোমার ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেসামরিক প্রাণহানির দায় এড়ানো সম্ভব নয়। বিভিন্ন স্কুল, তাঁবুর শিবির, মসজিদ ও বাসস্থান লক্ষ্য করে এই বোমা ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও ইসরাইলি বাহিনী বলেছে তারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, কোনো সতর্কতা দেয়া হয়নি। উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ২রা নভেম্বর বুরেইজ ক্যাম্পে হামলায় ১৫ জন নিহত হন। যার মধ্যে ৯ জন শিশু। ২৬ মে কুয়েতি শান্তি শিবির ১-এ হামলায় ৪৫ জন নিহত হন। শিশুর মাথা ও নারীর দেহ খণ্ডিত হয়।

জিবিইউ-৩৯ বোমায় ব্যবহৃত ডায়মন্ড ব্যাক উইং সিস্টেমের একমাত্র উৎপাদক এমবিডিএ। যদিও এমবিডিএ ইউকের কোনো পাবলিক আর্থিক প্রতিবেদন নেই। তবে এমবিডিএ ইউকের রাজস্বের শতকরা ৪০ ভাগের বেশি আসে এই মার্কিন শাখা থেকে। বৃটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি গত সেপ্টেম্বরে ২৯টি অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স স্থগিত করেন। তবে এতে এমবিডিএ ইনকরপোরেশনের কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত এবং ভিন্ন বোর্ড দ্বারা পরিচালিত।

ইসরাইলি সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট গাজায় মানবিক নগরী স্থাপনের পরিকল্পনাকে গভীরভাবে অপরাধপ্রবণ এবং দায়িত্বহীন বলে অভিহিত করেছেন। ক্যাম্পেইন এগেইনস্ট দ্য আর্মস ট্রেডের গবেষণা সমন্বয়কারী স্যাম পারলো-ফ্রিম্যান বলেন, এমবিডিএ চাইলে তারা তাদের মার্কিন শাখা বিক্রি করে দিতে পারে। তাহলে অন্তত তারা এই গাজা গণহত্যায় আর্থিক সহায়তাকারী হিসেবে থাকত না। জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেস্কা আলবানিজ এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, গাজায় গণহত্যা চলছে। কারণ এতে অনেকের লাভ হচ্ছে। এমবিডিএ নিজস্ব নৈতিক আচরণবিধিতে বলেছে, তারা মানবাধিকারের উপর নেতিবাচক প্রভাব রোধে সচেষ্ট। তবে তারা এই বিষয়ে জানায়নি যে তারা তাদের মার্কিন শাখা বিক্রি বা ইসরাইলে সরবরাহ বন্ধ করার কথা বিবেচনা করেছে কিনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *